জনাব কফিল উদ্দিন, বাড়ি গাইবান্ধার খোলাহাটি ইউনিয়নের পূর্বকোমরনই গ্রামে। বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশন এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকাকালীন জনাব কফিল উদ্দিন অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সাথে অর্পিত দায়-দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাচ্ছেন। দায়িত্বশীল এই ব্যক্তি কর্মজীবনের ফাঁকে সামাজিক কর্মকান্ডেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। গত শনিবার উত্তরাঞ্চলভিত্তিক স্থানীয় দৈনিক আজকের জনগণ পত্রিকার ভিএইড রোডস্থ কার্যালয়ে এসে গাইবান্ধার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে সাক্ষাতকার প্রদান করেন। জনাব কফিল উদ্দিন এর সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেন আজকের জনগণের নির্বাহী সম্পাদক আফতাব হোসেন।
আফতাব হোসেন: কেমন আছেন? আপনার শৈশব ও কিশোরকাল কোথায় কেটেছে?
কফিল উদ্দিন: আল্লার রহমতে ভাল আছি। আমার শৈশব ও কিশোর জীবন কেটেছে গ্রামের সাধারণ শিশুদের মতো গ্রামে। পূর্বকোমরনই গ্রামে বাবা-মাসহ ৫ ভাই ও ৬ বোন, চাচা-চাচীদের যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। পড়ালেখার পাশাপাশি সময় কেটেছে ঘাঘট নদীর পাড়ে খেলাধূলায়। দারিদ্রতার ছোঁয়া নিয়েই বড় হতে হয়েছে।
আফতাব হোসেন: আপনার পড়া লেখা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ?
কফিল উদ্দিন: মডার্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাস করে ভর্তি হই মডার্ণ হ্ইাস্কুলে। এর গাইবান্ধা সরকারি কলেজে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা করতে পারিনি। বন্ধুদের সাথে তাল মিলিয়ে রংপুর গিয়ে ভর্তি হই রংপুর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে। সাইন্সের স্টুডেন্ট হলেও ভর্তির সময় না থাকায় শেষ মহুর্তে বাধ্য হয়ে বাণিজ্য শাখায় ভর্তি হতে হয়। সেখানে মোটামুঠি ভাল রেজাল্ট নিয়েই আইএ পাস করে ভর্তি হই ঢাকা জগন্নাথ কলেজে।
আফতাব হোসেন: আপনার কর্মজীবন শুরু হল কিভাবে ?
কফিল উদ্দিন: ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকুরী করবো। তবে ভালছাত্র ছিলাম এটা বলা যেমন মুশকিল আবার খুব খারাব ছাত্র ছিলাম এটাও বলবো না। তবে, পড়াশুণার সাথে লেগেছিলাম। প্রতিটি বিষয়ে প্রচন্ড জানার আগ্রহ ছিল। বিসিএস-এ আবেদন করি। চাকুরীর প্রথম আবেদন, প্রথম চাকুরী। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় টিকে যাই। চয়েস ছিল প্রশাসন ক্যাডার। যোগদান করার আগেই মাস্টার রেজাল্ট হয়। ভাল ফল নিয়েই পাস করি। ইনশাল্লাহ চাকুরীর প্রথম আবেদনই একটা ভাল চাকুরী হয়। এজন্যই আমার একটাই কথা ভাল রেজাল্টের চেয়ে ভাল মানুষ হতে হবে।
আফতাব হোসেন: সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেন?
কফিল উদ্দিন: প্রথমে সহকারি কমিশনার হিসেবে যোগদান করি। ১৯৮৫ সালে বিসিএস এর ৭ম ব্যাচে। কিন্তু চাকুরীতে যোগদান করি ১৯৮৮ সালে। সহকারি কমিশনার, সহকারি কমিশনার (ভূমি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এডিসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক, ভূমি মন্ত্রণালয় এবং বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছি।
আফতাব হোসেন: পাট মন্ত্রণালয়ের বেহাল দশা! আপনি দায়িত্ব নিয়ে কি ধরণের পরিবর্তন আনতে পেরেছেন?
কফিল উদ্দিন: হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। বাংলাদেশ পাট শিল্পে যে সুনাম ছিল তা পরবর্তীতে ধ্বংশের শেষ প্রান্তে এসেছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এই শিল্পের অবস্থা বারোটা বাজিয়েছে। বর্তমানে কিন্তু পাট শিল্পের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে পাটের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনতে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পাট শিল্পগুলোকে উজ্জ্বীত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সবধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে। আমরা চিহ্নিত করছি আসলে কোন-কোন এলাকায় পাটকলগুলো চালু আছে। আর বন্ধ থাকা পাটকলগুলো কিভাবে চালু করা যায়। ইতোমধ্যে অনেক পাটকল চালু করা হয়েছে।
আফতাব হোসেন: পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়, জুট কর্পোরেশনের অধিকাংশ জমি না কি বেদখল অথবা নামেমাত্র লিজ নিয়ে প্রভাবশালীরা দখল করে আছে?
কফিল উদ্দিন: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। সরকারের পাট মন্ত্রনালয়ের হাজার হাজার একর জমির কোন হদিস ছিলনা। নানা কায়দায় নামে বেনামে এগুলো বেদখল ছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার দেশের সব জমিগুলো খুঁজে বের করেছি এবং কোন-কোন এলাকার জমি কি অবস্থায় আছে তা চিহ্নিত করেছি। কিছু জমি নায্যমূল্যে বিক্রি করে সরকারের রাজস্বখাতে কয়েকশ কোটি টাকা জমা করেছি। যেসমস্ত জমির মালিকানা নিয়ে আইনি জটিলতা আছে যেগুলো সমাধানে এনে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে।
আফতাব হোসেন: ফিরে আসি গাইবান্ধা প্রসঙ্গে-আপনি গাইবান্ধার সন্তান, মাঝে মাঝেই এলাকায় আসেন, বর্তমানে গাইবান্ধায় কি ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?
কফিল উদ্দিন: গাইবান্ধা আমার জন্মস্থান। বেড়ে উঠেছি গাইবান্ধায়। গাইবান্ধার পরিবর্তন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বর্তমানে গাইবান্ধা শহরের পৌরপার্কটি ভাললাগে। কিন্তু আরো ভাল লাগতো যদি দুটি পুকুরই থাকতো। কেননা উত্তর পার্শ্বের পুকুরটি ভরাট করে দোকান অফিস তৈরি করা হয়েছে, যা না করলেও হতো। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হয়েছে। নদীভাঙ্গন প্রতিরোধে অনেকস্থানেই স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয়ভাবে কিছু এনজিও গড়ে উঠেছে, যেমন গণ উন্নয়ন কেন্দ্র। এনজিওদের কার্যক্রম আসলেই মুদ্ধ করে। সরকারের উন্নয়ন অর্জনে এনজিদের কার্যক্রমও চোখে পড়ার মতো। জেলায় শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন হয়েছে।
আফতাব হোসেন: এতদিনেও কী কী উন্নয়ন হয়নি বলে আপনি মনে করেন?
কফিল উদ্দিন: আসলে অনেক কিছুর দৃশ্যমান উন্নয়ন হতো পারতো এবং সম্ভাবনাও ছিল। যেমন, রাস্তাঘাটের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ সরকারি অথবা বেসরকারি, স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে ক্ষুদ্র অথবা বৃহত কারখানা গড়ে তোলা।
জেলায় অনেক লোক আছে যারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আছে। নিজ-নিজ অবস্থান থেকে তারা দায়িত্ব নিলে কিন্তু যা বললাম তা অনেক আগেই সমাধান হতো। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ কিন্তু এসব ক্ষেত্রে খবুই তৎপর। তারা নিজ এলাকা নিয়ে ভাবে। একারনেই তাদের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো।
আফতাব হোসেন: গাইবান্ধার সার্বিক উন্নয়নে আপনার মতামত কি ?
কফিল উদ্দিন: উন্নয়ন যে হয়নি তা কিন্তু বলেনি। বলেছি আরো বেশি উন্নয়ন হতো পারতো। গাইবান্ধা জেলাকে অন্য জেলার মানুষ যেভাবে দেখে তা কিন্তু সঠিক না। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলনে কিন্তু আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। দারিদ্রতার হার কিন্তু কমেছে। মানুষের জীবনযাত্রার অনেক পরিবর্তন। সেইসময়ে কলেজে আমরা লু্িঙ্গ পড়ে ক্লাশ করেছি। সেইচিত্র কিন্তু আর নেই। পড়ালেখায় অভিভাবকেরা অনেক সচেতন। নারীরা মাঠে-ঘাটে কাজ করছে। যুবরা আত্মকর্মসংস্থানে কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। গ্রাম-গঞ্জের রাস্তা-ঘাট প্রায় সবই পাঁকা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন। জেলায় সবজি উৎপাদনের ব্যাপকতাও বেড়েছে। বামনড্ঙ্গাার উৎপাদিত ডিম সারা দেশে যাচ্ছে- এসব ছাড়াও অনেক উন্নয়ন হয়েছে, যা আমি হয়তো সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না।
আফতাব হোসেন: সুনির্দিষ্ট করে যদি বলতেন এই মুহুর্তে উন্নয়নে সম্ভাবনাগুলো কি-কি?
কফিল উদ্দিন: আমি কিন্তু আগেই বলেছি সমস্যাগুলো। সমস্যাগুলো উত্তরণে পদক্ষেপ নিলেই তো উন্নয়নের সম্ভাবনার মূখ উম্মোচন হয়। তারপরেও আমার মনে হয়, গাইবান্ধার উন্নয়নে এই মহুর্তে প্রয়োজন সাঘাটা- বগুড়া হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ চালু করা, বালাসী রেলঘাট ও ফেরি সচল রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা, পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন, স্থানীয়ভাবে যুবদের কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি।
আফতাব হোসেন: মূলতঃ আপনার অবস্থান থেকে আপনি কি করেছেন জেলার উন্নয়নে?
কফিল উদ্দিন: সরকারি চাকুরী করে একটি গন্ডির মধ্যে থাকতে হয়। তারপরেও আমি চেষ্টা করেছি যারাই আমার কাছে গেছে তাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছি। কিভাবে কোথায় গেলে কাজ হবে। আমার অবস্থান থেকে যেটুকু সহযোগিতা করা যায় পরামর্শ দিয়ে।
আমার ব্যক্তিগত উপলব্দি থেকে চিন্তা করেছি জেলার কর্ণধার ব্যক্তির একসাথে করা। তবে এক্ষেত্রে এককভাবে করলে হবে না। এই চিন্তুা থেকেই আগামী সপ্তাহে গাইবান্ধা জেলার ৭৭ জন ক্যাডার যারা বিভিন্ন দপ্তরে উচ্চ পদে আছেন, এমপি, হুইপ, ডেপুটি স্পীকার, বিচারপতি, এনজিও প্রধান, ব্যবসায়ী এদের নিয়ে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিয়েছি। এখান থেকেই জেলার উন্নয়নে রোডম্যাপ করা হবে। আমি মনে করে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি একটি করে পদক্ষেপ নেন তাহলেই কিন্তু অনেক কিছু হয়।
আফতাব হোসেন: ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, আপনি অবসর সময় কি করেন?
কফিল উদ্দিন: অবসর সময় খুবই কম। তারপরেও যেসময় পাই, পড়াশুণা করি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই।
আফতাব হোসেন: প্রিয় লেখক?
কফিল উদ্দিন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আফতাব হোসেন: ভাল লাগে?
কফিল উদ্দিন: কেউ ভাল উদ্যোগ নিলে।
আফতাব হোসেন: খারাপ লাগে?
কফিল উদ্দিন: মানুষের হীন মানষিকতা।
আফতাব হোসেন: খারাপ লাগে?
কফিল উদ্দিন: মানুষের হীন মানষিকতা।
আফতাব হোসেন: গাইবান্ধার গণমাধ্যম কর্মীদের সম্পর্কে কিছু বলুন?
কফিল উদ্দিন: গাইবান্ধার সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকেই ভাল রিপোর্ট করে। তবে, পেশাদার সাংবাদিকের অভাব রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শিখতে হবে। পজেটিভ সাংবাদিকতা করতে হবে।
আফতাব হোসেন: আপনাকে আজকের জনগণের পক্ষ থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
কফিল উদ্দিন: আপনাকেও ধন্যবাদ, ধন্যবাদ আজকের জনগণ পরিবারের সদস্যদের।