আফতাব হোসেন:
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় নারী দিবস। ৮ই মার্চ দিনব্যাপী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, এনজিও, সাংস্কৃতিক ও নারী সংগঠনগুলো বর্ণাঢ্য র্যালী, সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করবে। সম-অধিকার ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে রেওয়াজে পরিণত হওয়া অনুষ্ঠানের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে প্রত্যাশা এমনটই।
১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের একটি সূঁচ কারখানায় নারী শ্রমিকগণ বেতনবৃদ্ধি, কাজের সময় কমানোর দাবিতে আন্দোলন করার সময়ে পুলিশী বর্ববতার শিকার হয় তারা। পরবর্তীতে নারী শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে ১৮৬০ সালের ৮ই মার্চ ‘নারী শ্রমিক ইউনিয়ন’ গঠনের মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯১০ সালের ৮ই মার্চ কোপেন হেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান নারী নেত্রী কমরেড কারা সেৎকিন দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই সারাবিশ্বে নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে। ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। একই কারণে আমাদের দেশেও দিবসটি উদযাপিত হয় অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতভাবে নারী মুক্তি, নারীর সম-অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং নারী উন্নয়নে যতটুকু অর্জন, এই দিবসটি প্রতিবছর পালনের মাধ্যমেই তা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়। বিগত শতকের গোড়ার দিকে নারী জাগরণের আলো জ্বেলেছিলেন বেগম রোকেয়া। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্কুল। সেই থেকে নারী সমাজ ক্রমাগত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ জাতি ও জাগরণের জন্য রাখছে ভূমিকা। নারী আন্দোলনকে আজ পর্যন্ত বেগমান করে তুলছে তারা। এ দেশে নারী উন্নয়নে সরকার ও বিরোধী দলের পাশাপাশি কাজ করছে অসংখ্য এনজিও। তবুও বাংলাদেশের নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক পেঁছনে। এখনো এ দেশের নারীদের উপর এসিড নিক্ষেপের মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। নারীরা যৌতুকের শিকার, কর্মজীজী-শ্রমজীবী নারীদের উপর মানসিক নির্যাতন, বেতন বৈষম্যসহ হাজারো সমস্যা একজন নারীকে এখনো ভয় ও আতংকগ্রস্ত করে।
বর্তমান মহাজোট সরকার নারী উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে করলেও প্রকৃতপক্ষে নারীরা রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে। আমাদের দেশের সংবিধানে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও নারীরা শোষণ-বঞ্চনা,অবহেলা-অনুন্নয়নের শিকার। সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সম-আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে আছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। সংবিধানের ২৯নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে নাগরিকের জন্য সমতা থাকবে। কিন্তু সংবিধানের উল্লিখিত উক্তিটিকে উপেক্ষা করেই যেন নারীদের অবদমিতভাবে সমাজে জায়গা করে দেয়া হচ্ছে। যেন অনেকটা সুযোগ আর কি। সামাজিক, র্অথনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগতক্ষেত্রে বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়েই দেশের নারীরা সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে। অথচ সকল পুরুষেরা নারীদের সমস্যা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করার সময় এখনই। প্রায় এক শত চুয়ান্ন বছর আগে নিউইয়র্ক শহরে নারীরা কাজের পরিবেশ ও বেতন বৈষ্যম্য নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। অথচ আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের উপর শোষণের মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এখনো এদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীদের বেতন বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের কাজ-কর্মে নিয়োজিত পুরুষের তুলনায় কম।
নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে পণ্য হিসাবে। বিভিন্ন অঙ্গনে নারীদেও ব্যবহার করে পুঁজিপতিরা কোটি কোটি টাকা আয় করছে। পত্রিকার পাতা খুললেই আজও চোখে পড়ে গ্রাম ও শহরে যৌতুকের জন্য নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ, অমর্যাদাকর হিল্লা বিবাহ, শিশু বিবাহ, স্ত্রী নির্যাতন, তালাক প্রভৃতির মাধ্যমে নারী নির্যাতনের অগনিত চিত্র। নারী সমাজের একটি কাহিনী ধরে টান দিলে মহাপুরাণ আর মহাকাব্য হয়ে যায়। পুরুষতান্ত্রিক বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার শিকার যে অগনিত নারী তার উজ্জল দৃষ্টান্ত পঁচাগলা এ সমাজের ধর্ষিতা ফাহিমা, ইন্দ্রানি, ইয়াসমীন সীমা, নূরজাহান, শবমেহের, স্বপ্নাহার, মহিমা, মিমিরা।
কিছু কিছু সরকারি উদ্যোগে নারীর উন্নয়ন প্রশংসার দাবি রাখে সত্য। যেমন একাদশ শ্রেনি পর্যন্ত নারীদের বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ, বিধবা ভাতা, সরকারিভাবে আইনগত সহায়তা ইত্যাদি। এছাড়াও কর্মসংস্থান, পারিবারিক আদালত গঠন, যৌতুক প্রথা বিরোধী আইন, সংসদে-স্থানীয় সরকারে ও প্রশাসনের বিভিন্নপদে নারী প্রতিনিধি প্রভৃতি উরেøখযোগ্য। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারী প্রতিনিধি নির্বাচন এ দেশের নারী অধিকার ও নারী উন্নয়নে প্রশংসার দাবী রাখে। তবে এসব প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে যথাযোগ্য কাজের সুযোগ দানের সুব্যবস্থা না করে নারী প্রতিনিধিদের পুতুল বানিয়ে রাখার ব্যাপার যাতে না হয়।
এদেশের শিতি নারীদের নীতি নির্ধারণী ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বে আসীন করে তাদের উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে হবে। সম-আন্তরিকতায় নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখা জরুরী হয়ে পড়েছে। শিক্ষিত নারীদের অনেকেই সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত। তাদেরকেও নিগৃহীত নারীদের পক্ষ নিতে হবে। কেরানি, অফিসার, উকিল, ডাক্তার, নার্স, প্রকৌশলী, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, কলামিষ্ট ও সাংবাদিকতা পেশায় যে সকল নারীরা জড়িত তাদের এগিয়ে আসতে হবে পুরুষতন্ত্র ও অনিয়ম-দুর্নীতি-শোষণ-বঞ্চনা-অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশের তৈরি পোষাক শিল্প মূলত এদেশের নারী শ্রমিকদের উপর ভিত্তি করেই গঠিত। এদেশের পুঁজিতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতিতে নারীরা এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এক হিসাবে দেখা যায়, নারী শ্রমশক্তির ৮৩ শতাংশ হচ্ছে অবৈতনিক গৃহস্থালী শ্রমিক, ১০ শতাংশ আত্ম কর্মসংস্থান, ৪ শতাংশ বেতনভোগী শ্রমিক এবং ৪ শতাংশ দিনমজুর। শহরাঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং কৃষি উৎপাদক খাতে বেশিরভাগ নারীরা কর্মরত। মাত্র ১.৭ শতাংশ নারী কারিগরি ও পেশাদারি খাতে নিয়োজিত। কর্মক্ষেত্রে বা অন্যত্র নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আজ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে।
সরকারী সুযোগ সুবিধা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রশিণের বিষয়েও নারীদের দাবী বাড়ছে। ধীরে ধীরে শিা গ্রহণের ও কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় নারীদের মধ্যে বিপুল সাড়া জেগেছে। গ্রামাঞ্চলেও নারী শিার মাধ্যমে নারীরা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার আগ্রহ বেড়েছে। তাই নারী দিবসের ভাবনা হচ্ছে, সমন্বিত উদ্যোগে নারী পুররুষর সম মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কার্যকর সংগ্রাম জোরদার করা। নারীর সামাজিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতায়ন নিশ্চিত করে নারী মুক্তির মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন করাই হচ্ছে নারী দিবস পালনের মূল তাৎপর্য।
লেখক: আফতাব হোসেন, উন্নয়ন কর্মী ও সাংবাদিক